আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়: বিজ্ঞানের আলোয় দেশ গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়: বিজ্ঞানের আলোয় দেশ গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা
Blog Article
[caption id="" align="aligncenter" width="312"] Prafulla Chandra Roy[/caption]
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সংক্ষেপে পি. সি. রায়, (১৮৬১-১৯৪৪) ছিলেন একাধারে বাঙালি রসায়নবিদ, শিক্ষক, দার্শনিক এবং শিল্পপতি। পরাধীন ভারতে বিজ্ঞানের চর্চা ও শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। তাঁর অসামান্য অবদান শুধু রসায়নশাস্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং শিক্ষা, সমাজসেবা এবং স্বদেশী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তিনি এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।
১. প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা:
১.১ জন্ম ও বংশপরিচয়:
১৮৬১ সালের ২ আগস্ট খুলনা জেলার (তৎকালীন যশোর) রাড়ুলি-কাটিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম হরিশচন্দ্র রায় এবং মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। হরিশচন্দ্র রায় ছিলেন একজন ভূস্বামী এবং সংস্কৃতিমনা মানুষ। তাঁর বাড়িতে নিয়মিত সাহিত্য ও শাস্ত্র চর্চা হতো। এই সাংস্কৃতিক পরিবেশে প্রফুল্লচন্দ্রের মননশীলতা বিকাশের সুযোগ পায়।
১.২ শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা:
প্রফুল্লচন্দ্রের শৈশব কাটে গ্রামের শান্ত পরিবেশে। চার বছর বয়সে গ্রামের পাঠশালায় তাঁর হাতেখড়ি হয়। এরপর তিনি রাড়ুলি মধ্য ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি অল্প বয়সেই শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৮৭০ সালে হরিশচন্দ্র রায় সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন।
১.৩ কলকাতা ও উচ্চশিক্ষা:
কলকাতায় এসে প্রফুল্লচন্দ্র হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয়ে দু’বছর শয্যাশায়ী থাকেন। এই সময় তিনি প্রচুর বই পড়েন এবং ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রতি আকৃষ্ট হন। সুস্থ হয়ে তিনি অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৮৭৮ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এরপর তিনি বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। রসায়নশাস্ত্রের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ জন্মায়। তিনি সহপাঠীদের সঙ্গে মিলে বাড়িতেই একটি ছোটখাটো রসায়ন গবেষণাগার তৈরি করেন এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকেন।
১৮৮২ সালে তিনি এফ.এ. পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে ১৮৮২ সালে তিনি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করতে যান। সেখানে তিনি কঠোর পরিশ্রম করে ১৮৮৫ সালে বি.এস.সি. এবং ১৮৮৭ সালে রসায়নশাস্ত্রে ডি.এস.সি. ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণাপত্র ‘কপার ও ম্যাগনেসিয়াম শ্রেণীর যুগ্ম সালফেটের গঠন’ (On the constitution of double sulphates of the copper-magnesium group) এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়।
২. রসায়নশাস্ত্রে অবদান:
২.১ মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার:
১৮৯৫ সালে প্রফুল্লচন্দ্র রায় পারদ ও নাইট্রিক অ্যাসিড নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে মারকিউরাস নাইট্রাইট (Mercurous Nitrite) আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কার রসায়ন জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। এটি ছিল ভারতীয় রসায়ন গবেষণার এক যুগান্তকারী ঘটনা।
২.২ বেঙ্গল কেমিক্যালস প্রতিষ্ঠা:
প্রফুল্লচন্দ্র রায় শুধু একজন গবেষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন শিল্পোদ্যোক্তাও। তিনি উপলব্ধি করেন, পরাধীন ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি প্রয়োজন। এই ভাবনা থেকে তিনি ১৮৯২ সালে মাত্র ৮০০ টাকা পুঁজি নিয়ে বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল ভারতের প্রথম ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা। এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি দেশীয় শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
২.৩ রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস:
প্রফুল্লচন্দ্র রায় ‘হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি’ (History of Hindu Chemistry) নামে দুই খণ্ডে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি প্রাচীন ভারতে রসায়নশাস্ত্রের চর্চা এবং তার অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই গ্রন্থ প্রাচীন ভারতীয় রসায়ন চর্চার এক মূল্যবান দলিল।
৩. শিক্ষা ও সমাজসেবা:
৩.১ শিক্ষকতা:
প্রফুল্লচন্দ্র রায় কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। তাঁর সহজ ও সাবলীল শিক্ষাপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের কাছে বিজ্ঞানকে আকর্ষণীয় করে তোলে। তিনি শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান গবেষণায় উৎসাহিত করতেন।
৩.২ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা:
তিনি শুধু শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদানে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেন। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (বর্তমান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) এবং ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি।
৩.৩ সমাজসেবা:
প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন একজন সমাজসেবী। তিনি দরিদ্র ও অসহায় মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন কাজ করেন। দুর্ভিক্ষের সময় তিনি ত্রাণকার্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব।
৪. স্বদেশী আন্দোলন ও দেশপ্রেম:
৪.১ স্বদেশী শিল্পে উৎসাহ:
প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বদেশী শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পরাধীন ভারতে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য স্বদেশী শিল্পের বিকাশ প্রয়োজন। তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালসের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
৪.২ অসহযোগ আন্দোলনে সমর্থন:
তিনি অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং বিদেশি পণ্য বর্জনের আহ্বান জানান। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও প্রয়োজন।
৪.৩ দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ:
প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান ও শিল্পের মাধ্যমে দেশের উন্নতি সম্ভব। তাঁর জীবন ও কর্ম পরাধীন ভারতের যুবকদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগিয়ে তোলে।
৫. দার্শনিক চিন্তাধারা ও জীবনদর্শন:
৫.১ বিজ্ঞান ও দর্শনের সমন্বয়:
প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন একজন দার্শনিক। তিনি বিজ্ঞান ও দর্শনের সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রকৃতিকে জানা যায়, আর দর্শনের মাধ্যমে জীবনের গভীর অর্থ উপলব্ধি করা যায়।
৫.২ সরল জীবনযাপন:
তিনি ছিলেন একজন সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনে বিশ্বাসী মানুষ। তিনি চিরকুমার ছিলেন এবং তাঁর জীবন ছিল বিজ্ঞান গবেষণা ও দেশ সেবার জন্য নিবেদিত।
৫.৩ মানবতাবাদ:
প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন একজন মানবতাবাদী। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের কল্যাণের জন্য বিজ্ঞান ও শিল্পের ব্যবহার করা উচিত। তিনি দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।
৬. উত্তরাধিকার ও মূল্যায়ন:
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন এক বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি শুধু একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না, বরং একজন সমাজসেবী, শিল্পপতি এবং দার্শনিকও ছিলেন। পরাধীন ভারতে বিজ্ঞান চর্চা ও শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। তাঁর অসামান্য অবদান আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তিনি ছিলেন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ।
প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জীবন আমাদের শেখায় যে, নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতেও সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। তিনি ছিলেন এক আলোকবর্তিকা, যা আজও আমাদের পথ দেখায়। তাঁর আদর্শ ও কর্ম আমাদের দেশের যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করে।
Report this page